আমি
একজন হিন্দু, আমার জন্ম এক হিন্দু বাবা ও হিন্দু মায়ের ঘরে, তাই
জন্মসূত্রে আমি একজন হিন্দু। আমার কোনো ধর্মীয় প্রবক্তা বা আমার কোনো
নির্দিষ্ট একটি ধর্মগ্রন্থ নেই বরং আমার আছে শত শত, হাজার হাজার ধর্মীয় ও
দার্শনিক গ্রন্থ। হিন্দু ধর্মকে বিশ্বের বর্তমান 'ধর্মমত'-গুলোর সাথে আপনি
তুলনা করতে পারবেন না। কোনো ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেও আপনি হিন্দু হতে পারেন।
হিন্দু ধর্ম সেই সভ্যতার শুরু থেকেই চলে আসছে, টিকে আছে নানা প্রতিকূলতাকে
ও সমালোচনাকে সাথে নিয়ে। আমি প্রতিনিয়ত মন্দিরে যেতাম না। আমি নিয়মিত
ধর্মীয় আচার-নিষ্ঠা পালন করতাম না। কেউ আমার উপর কখনো চাপ প্রয়োগ করেনি
এসব নিয়ম-নিষ্ঠা পালন করার জন্য। ছোটবেলায় ধর্মীয় উৎসবসমূহে অংশ নিতাম ও
খুব উপভোগ করতাম। ঈশ্বর আমার বন্ধুর মতো। আমি ঈশ্বরকে ভয় পাই না। যদি আমি
হিন্দুধর্মের কিছু আচার-নিষ্ঠাকে চ্যালেঞ্জও করি তবুও কেউ আমাকে অন্য
ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে পারবে না বা প্রাণে মেরে ফেলবে না। কারণ একজন
হিন্দু হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে ও বস্তুনিষ্ঠভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে পারি,
কোনো প্রকার শর্তাবলী ছাড়াই। এমনকি প্রকাশ্যে সমালোচনা করতেও পারি। আমাকে
কেউ মেরে ফেলবে না। আসলে হিন্দুধর্ম কোনো ধর্মমত নয়, এক বিশ্বাস ও
রীতি-নীতি। মানুষের সভ্য হবার পদ্ধতি ও 'মানুষ' হওয়ার সংস্কৃতি। এ কোনো এমন
ধর্ম নয় যা কোনো এক ব্যক্তির দ্বারা প্রচারিত অথবা এর কোনো সংগঠিত সংঘ বা
সমিতি নেই। হিন্দুধর্মে কোনো সংস্থাপণ বা কর্তৃত্বধারী গোষ্ঠী নেই। আমাদের
ঈশ্বর সম্পর্কে ভাবনা একজন ব্যক্তিগত ঈশ্বরের মতো নয়। এ তো আমাদের কাছে
ভাবনারও অতীত যে আমি একজন 'ব্যক্তির মতো ঈশ্বর'-এর আরাধনা করব -- যিনি কিনা
এমন যে, মেঘের মাঝে লুকিয়ে থেকে তার পছন্দমত 'বার্তাবাহক'-এর মাধ্যমে
নির্দেশ দিচ্ছেন এমনভাবে যেন আমাদের তাকে উপাসনা করতেই হবে, আর না করলেই
শাস্তি। আসলে হিন্দুধর্ম হলো একজন ব্যক্তির ধর্ম, ব্যক্তির জন্য ধর্ম,
ব্যক্তির দ্বারা ধর্ম যার শিকড় রয়েছে গীতার মতো ধর্মগ্রন্থে আর সাধনা
রয়েছে চণ্ডীর মতো ধর্মগ্রন্থে। পুরো বিষয়টা হলো একজন ব্যক্তির ঈশ্বরের
কাছে পৌঁছানো তার নিজস্ব ব্যক্তিগত মাধ্যমে, তার নিজস্ব মানসিকতা ও
অন্তর্নিহিত বিবর্তনের মাধ্যমে। কেউ কাউকেও হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করতে
পারবে না। এ কোন ধর্মমত নয়, বরং এক জীবনপ্রণালী, জীবনে চলার রীতি-নীতি
সম্বলিত ব্যবস্থা। সকল কিছুই হিন্দুধর্মে গ্রহণযোগ্য কারণ, কোনো একক
কর্তৃত্বধারী বা সংগঠন নেই যা এর ব্যবস্থাকে বাতিল ঘোষণা করবে বা এর
বিরুদ্ধে প্রশ্ন করবে। তাই একমাত্র এখানেই আপনি পাবেন জীবনের অর্থ। সৃষ্টির
সকল কিছুকে ভালোবাসাই হলো পরম সত্য.......- ঈশ্বর বিরাজিত সকল
কিছুতেই...... কিছুই ঈশ্বর থেকে দূরে নয় কারণ ঈশ্বর সকল কিছুতেই.... সকল
জীব ও জড়কে ঈশ্বর জ্ঞানে সম্মান করা উচিত আমাদের...... এ'সবই হিন্দুধর্ম
আমাদের শিক্ষা দেয়। এই কারণেই একে বলে সনাতন ধর্ম, চিরন্তন বিশ্বাস। এ এক
ধর্ম নামক রীতি দ্বারা চালিত যার অর্থ 'জীবন চলা'-র প্রথা। হিন্দুধর্মের
সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে নিজের প্রতি সৎ থাকা। এর কোনো একক ধ্যান-ধারণা
নেই। এটি সকল কিছুর কাছেই উন্মুক্ত। হিন্দুরা এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে যিনি
আবার নানা রূপধারণও করতে পারেন প্রয়োজন অনুযায়ী। হিন্দুদের কাছে ঈশ্বর
সময়হীন ও আকারহীন। বর্তমান হিন্দুদের আদি পূর্বপুরুষরা বিশ্বাস করতেন
চিরন্তন সত্য ও মহাজাগতিক নিয়ম-কানুনে। এইসব সত্য বা নিয়ম-কানুন সবার
কাছে উন্মুক্ত যে এ সম্পর্কে আরো গভীরে যেতে চান। কিন্তু হিন্দুদের মাঝেও
এমন অংশবিশেষ রয়েছে যারা কুসংস্কারেও বিশ্বাস করে। হিন্দুধর্মের দার্শনিক
দিকগুলো এসব কুসংস্কারকে ভুল প্রমাণ করে। কেউ কাউকেও হিন্দুধর্মে
ধর্মান্তরিত করতে পারবে না এ কোনো ধর্মমত নয়, এ'টা একমাত্র 'ধর্ম'। অভারতীয়রা
হিন্দু শব্দটির জন্ম দেয় সিন্ধু নদের উপত্যকায় উৎপত্তির জন্য। এর ফলে ওই
অঞ্চলের মানুষদের তখন হিন্দুধর্মাবলম্বী হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। ধর্মমতগুলো
এক 'মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং ইন্ডাস্ট্রী'-তে রূপান্তরিত হয়ে যা
বিবাহ-ধর্মান্তর এসবের মাধ্যমে নিজের গোষ্ঠীর লোকসংখ্যা বাড়িয়ে 'মার্কেট
শেয়ার' বাড়াতে চাইছে। কিন্তু আমি একজন হিন্দু। আমি মানি - 'অহিংসা
পরমো ধর্ম' - অসহিংসতা হচ্ছে সর্বোচ্চ কর্তব্য। আমি একজন হিন্দু কারণ
হিন্দুধর্ম অহিংসতার ডাক দেয়। আমি একজন হিন্দু কারণ আমি আমার মনকে কোনো
বিশ্বাস ব্যবস্থার সাথে শর্ত জুড়ে দিই না। আমি একজন হিন্দু কারণ
হিন্দুধর্ম হচ্ছে জগতের প্রথম উৎপন্নিত ব্যবস্থা যা মানুষকে 'মানুষ' হ'তে
শিখায়। কিন্তু কোনও একজন হিন্দু পুরুষ/মহিলা, যে তার জন্মগত ধর্ম থেকে
বিচ্যুত হয়, সে তার নিজস্ব আদর্শ, সংস্কৃতি ও জীবনের মূল্যবোধকে মূল্য
দেয় না।
No comments:
Post a Comment