বিজয়াদশমী একদিকে আনন্দের, অন্যদিকে বিসর্জনের বেদনার। এই দিনে মাতৃরুপেন দেবী দূর্গা মহাবলী পদ্ম নামক দৈত্যকে বদ করে ধর্ম সংস্থাপন করেছিলেন এবং বিজয়া হয়েছেন। তাই, প্রাচীনকালে রাজারা এই দিনে যুদ্ধযাত্রা করতেন। আজকের দিনে শপথ হোক অসুরদের বিপক্ষে, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে, মনুষ্যত্বের পক্ষে, দেশ ও জগতের কল্যাণের তরে। অপরদিকে দশমীর দিন মা মর্ত্যলোক থেকে পুনরায় কৈলাসে পাড়ি দেন।
তাই বিসর্জন আমাদের কাছে কষ্টের, বেদনার ও আবেগের। জনশ্রুতি আছে যে রাণী রাসমনির জামাতা মথুর পূজার দিন আনন্দে আপ্লুত হয়ে পুরোহিত রামকৃষ্ণদেবকে বলেছিলেন, "আমি এই আনন্দের হাট ভাঙতে দিব না"।তখন রামকৃষ্ণদেব তাঁকে বোঝান,"বিজয়ার অর্থ দেবীমা ও সন্তানের বিচ্ছেদ নয়। মা কখনও তার সন্তানের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন না। এতদিন মা দালানে বসে পুজো নিয়েছেন এরপর মা হৃদয়মন্দিরে বসে পুজো নেবেন"। এরপরেই মথুর শান্ত হন এবং বিসর্জন হয় মা দুর্গার প্রতিমা। বছরান্তে ভক্তদের কল্যাণে মা আবার আবির্ভূত হবেন। তাই বিসর্জন বলতে আত্মপ্রতিষ্ঠা বুঝায়।
আজকের এইদিনে ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু, রাজা-প্রজা, পন্ডিত-মূর্খ বিবেচনা না করে সবাই একাত্মবোধে আবদ্ধ। এটাই বিজয়া দশমীর তাৎপর্য, শুভ বিজয়ার চেতনা। সাধারণত বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় বাঙলাতে দূর্গাপূজা সার্বজনীনতা লাভ করে। দেবী দূর্গার প্রতিরোধের চেতনার জন্য দেবী দূর্গাকে জাতীয়তাবাদের প্রতীক বিবেচনা করা হয়। দেবী দূর্গার দর্শন থেকেই ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর আনন্দমঠ উপন্যাসে 'বন্দে মাতরম' কবিতাটি সংকলন করেন এবং যা পরবর্তীতে ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনে ভারতবাসীকে প্রাণিত করেছিলেন। তাই নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুসহ অনেক জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবীনেতা এই দুর্গাপুজার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।
দেবীদুর্গাকে উদ্দেশ করে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর 'আন্দময়ীর আগমনে' কবিতায় লিখেছিলেন, ‘দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা/ দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা/ “ময় ভুখা হুঁ মায়ি” বলে আয় এবার আনন্দময়ী/ কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!’ এবং এই কবিতা প্রকাশের পর কবিকে ব্রিটিশ সরকার জেলে পুরেছিল। ভারতবর্ষের বাঙালি সনাতনীদের মানসে দেবীদুর্গা প্রতিবাদের দেবী, প্রতিরোধের দেবী। একই সঙ্গে তিনি ‘মাতৃরূপেণ’ ও ‘শক্তিরূপেণ’। আবার তিনি অসহায় ও নিপীড়িতের আশ্রয় বলেও গণ্য হন। তাঁর এক রূপ অসুরবিনাশী, আরেক রূপ মাতৃময়ী ভালোবাসার। তিনি দুর্গতিনাশিনী ও অসুরবিনাশিনী। তাই বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবকালীন সময়ে কিংবা নারীর প্রতি ক্রমবর্ধমান সহিংসতা পরিস্থিতিতেও আজো দেবী দুর্গার আহবান সমান গুরত্বপূর্ণ।
আবহমানকাল ধরে বাঙালি সনাতনী নারীরা মহালয়া থেকেই একপ্রকার দশমী উদযাপনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। কারণ পুজা আসতে না আসতেই দশমী চলে আসত। নারিকেলে নাড়ু, নিমকি, বাতাসা, নানান পদের মিষ্টিসহ বানানো হতো অনেক কিছু। পুজোর আগে এটো হবে বলে এসব থাকতো শিশুদের নাগালের বাইরে। আজকাল এসব সংস্কৃতি ম্রিয়মাণ। এখন বিসর্জনের পরেই বাড়ির কর্তারা লাইন পড়ে মিষ্টির দোকানে। অনেকে তো আজকাল মিষ্টির বদলে পিৎজা, কুকিজ দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছে দশমী। ঘড়োয়া আয়োজন গুলো রেস্টুরেন্টে স্থানান্তরিত। অথচ সমাজবিজ্ঞান বলে একটা সংস্কৃতির নিউক্লিয়াস হচ্ছে ঘড়োয়া সংস্কৃতি।
বিজয়া দশমী সেরকম একটি ঘড়োয়া সংস্কৃতি যা সময়ের সাথে সাথে নানাভাবে বিবর্তিত হয়েছে। এই বছর তো করোনার কারণে এক গা বাড়িয়ে অনলাইনে হয়েছে মায়ের অঞ্জলি। দশমীর প্রণাম-শুভেচ্ছা বিনিময় হচ্ছে
মেসেঞ্জার কিংবা ওয়াটঅ্যাপে। তবে বিবর্তনের পরেও এখনো বিজয়া দশমী রয়ে গেছে বাঙালির হৃদয়জুড়ে।
লেখকঃ অনুপম দাশ
No comments:
Post a Comment