
প্রশ্ন:
৪২ উত্তর: অনেকে অভিযোগ করেন, মনুসংহিতা সামগ্রিকরূপে একটি নারীবিরোধী
শাস্ত্র। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, পণ্ডিত ও বিদ্বান সমাজ একথা বহুবার স্বীকার
করেছেন যে, মনুসংহিতা নামক স্মৃতিশাস্ত্রটি তে বহু প্রক্ষিপ্ত অংশ রয়েছে।
এর মানে এই যে, জাতিগত বা সময়গত বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে এই পবিত্র
গ্রন্থটিতে অনেক কাঁটাছেঁড়া করা হয়েছে। শ্লোক রচনার গঠন রীতির আধুনিকতা ও
প্রাচীনতা বিবেচনা করে এই জাল শ্লোকগুলো আলাদা করা খুব কঠিন কিছু নয়। আদি
মনুসংহিতা শাস্ত্রটি অধ্যয়ন করলে যে কেউ গর্বভরে দাবি করতে পারবেন যে,
পৃথিবীতে নারীকে মর্যাদা দানে মহর্ষি মনুর মতো এতো চমৎকার সব বিধান আর কোন
ধর্মনেতা কোন কালেই প্রদান করেননি। এমনকি মনুসংহিতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ
হতে হলে অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক নারীবাদীদের চিন্তাধারারও উন্নয়নের
প্রয়োজন। এখানে অত্যন্ত সংক্ষেপে মনুস্মৃতির আলোকে বিষয়টা আলোচনা করা হলো।
আমরা এখন এমন একটি শ্লোক পড়ব যার অর্থ দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করে যে
নারীরাই হচ্ছে কোন উন্নত সমাজের ভিত্তিস্বরূপ। এটি মনুসংহিতার তৃতীয়
অধ্যায়ের (ধর্মসংস্কার প্রকরণ) শ্লোকঃ যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে
তত্র দেবতাঃ। যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলা ঃ ক্রিয়াঃ।।
(মনুসংহিতা ৩/৫৬) অর্থাৎ “যে সমাজে নারীদের যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান
প্রদর্শন করা হয় সেই সমাজ উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করে। আর যারা নারীদের
যোগ্য সম্মান করে না, তারা যতই মহৎ কর্ম করুক না কেন, তার সবই নিষ্ফল হয়ে
যায়।” এটি নারীদের প্রতি কোন চাটুকারিতা বা তোষামদি নয়। এটি এমন একটি সত্য
যা নারীবিদ্বেষীদের কাছে বিষের মতো, আর নারীশক্তির মহিমা কীর্তনীয়াদের
কাছে অমৃতস্বরূপ। প্রকৃতির এই নিয়ম পরিবার, সমাজ, ধর্মগোষ্ঠী, জাতি বা
সমগ্র মানবতার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। যারা মনুস্মৃতিকে দোষারোপ করেন,
তারা কখনোই এই শ্লোকের উদ্ধৃতি দেন না। উদ্দেশ্যপ্রণোদি তভাবে শুধুমাত্র
হিন্দুধর্ম সম্পর্কে কুৎসা প্রচারই তাদের একমাত্র কাজ। নিরপেক্ষ বিচার
তাদের কাছে নেই। যেমন নিচের চমৎকার শ্লোকগুলোর কথা কোন ব্লগার বা
হিন্দুধর্মের সমালোচক উল্লেখ করেন না: “একজন পিতা, ভাই, পতি বা দেবর তাদের
কন্যা, বোন, স্ত্রী বা ভ্রাতৃবধুকে মৃদুবাক্য, ভদ্র ব্যবহার ও উপহারাদি
দ্বারা খুশি ও সন্তুষ্ট রাখবেন। যারা যথার্থ কল্যাণ ও উন্নতি চান, তারা
নিশ্চিত করবেন যে, তাদের পরিবারের নারীরা যাতে সর্বদা খুশী থাকেন এবং কখনো
দুর্দশা ভোগ না করেন”। (মনুসংহিতা ৩/৫৫) “যে বংশে ভগিনী ও গৃহস্থের স্ত্রী
(নারীকূল) পুরুষদের কৃতকর্মের জন্য দুঃখিনী হয়, সেই বংশ অতি শীঘ্র
ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আর যে বংশে স্ত্রীলোকেরা সন্তুষ্ট থাকে, সেই বংশ
নিশ্চিতভাবেই শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে”। (মনুসংহিতা ৩/৫৭) ভেবে দেখুন, পরিবারের
সুখ- শান্তি-সমৃদ ্ধির জন্য এর চেয়ে বড় কথা আর কি হতে পারে? এখানে
পুরুষতান্ত্রিকত া চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। নারীকে সর্বদা সুখী রাখতে হবে - এটাই
মহর্ষি মনুর নির্দেশ। “যে স্বামী তার স্ত্রীকে সন্তুষ্ট রাখে না, সে তার
সমগ্র পরিবারের জন্য দুর্দশা বয়ে আনে। আর যদি স্ত্রী পরিবারের প্রতি সুখী
থাকেন, তবে সমগ্র পরিবার শোভাময় হয়ে থাকে।” (মনুসংহিতা ৩/৬২) “যে বংশকে
উদ্দেশ্য করে ভগিনী, পত্নী, পুত্রবধূ প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা অনাদৃত, অপমানিত
বা বৈষম্যের শিকার হয়ে অভিশাপ দেন, সেই বংশ বিষপান করা ব্যক্তি ন্যায়
ধন-পশু প্রভৃতির সাথে সর্বতোভাবে বিনাশপ্রাপ্ত হয়।” (মনুসংহিতা ৩/৫৮)
পুরুষতান্ত্রিক যে সমাজে নারীনির্যাতন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, নারীকে
যথেচ্ছা সম্ভোগ, প্রহার বা তাড়িয়ে দেওয়ার বিধানও যে সমাজ অনুমোদন করে, সেই
সমাজ যে ক্রমেই বিনাশপ্রাপ্ত হবে - এটাই তো স্বাভাবিক। বিশ্বের প্রতিটি
নারীর ব্যক্তিগত জীবনের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও সর্বাঙ্গীন মঙ্গলের লক্ষ্যে,
নারীর অপমান ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে মহর্ষি মনু যে দৃপ্ত বাণী উচ্চারণ করেছেন,
তাতে তো মনুকে বরং কট্টর নারীবাদী বলেই মনে হয়, তাই না? “যারা ঐশ্বর্য
কামনা করে, তারা স্ত্রীলোকদের সম্মান প্রদর্শন দ্বারা খুশী রাখবে এবং উত্তম
অলংকার, পোশাক ও খাদ্যদ্বারা প্রীত রাখবে। স্ত্রীজাতিকে সর্বদা পবিত্র
হিসেবে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করবে।” (মনুসংহিতা ৩/৫৯) শ্লোকটিকে খুব নারীবাদী
মনে হতে পারে, তবে মহর্ষি মনু মোটেও পুরুষতান্ত্রিক বা নারীবাদী কোনটাই নন,
তিনি মানবতাবাদী। মনে রাখবেন ‘মনু’ শব্দ থেকেই ‘মানব’ ও ‘মানবতা’ শব্দের
উৎপত্তি। “স্ত্রী লোকেরা সন্তানাদি প্রসব ও পালন করে থাকে। তারা নতুন
প্রজন্ম বা উত্তরসুরির জন্ম দেয়। তারা গৃহের দীপ্তি বা প্রকাশস্বরূপ। তারা
সৌভাগ্য ও আশীর্বাদ বয়ে আনে। তারাই গৃহের শ্রী।” (মনুসংহিতা ৯/২৬) আজও
ভারতবর্ষে মহর্ষি মনুর এই শ্লোক থেকেই শিক্ষা নিয়ে মেয়েদের ‘ভাগ্যশ্রী’,
‘ঘরের লক্ষ্মী’ বা ‘গৃহলক্ষ্মী’ বলা হয়। “প্রজন্ম থেকে প্রজন্মোন্তরে
স্ত্রীরাই সকল সুখের মূল। কারণ, সন্তান উত্পাদন, ধর্ম পালন, পরিবারের
পরিচর্যা, দাম্পত্য শান্তি এসব কাজ নারীদের দ্বারাই নিষ্পন্ন হয়ে থাকে।”
(মনুসংহিতা ৯/২৮) অন্যকথায়, মাতৃরূপে, কন্যারূপে, স্ত্রীরূপে, ভগ্নীরূপে
কিংবা ধর্মকর্মে অংশীদাররূপে নারীরাই সকল কল্যাণের মূল উত্স বলে মহর্ষি মনু
প্রতিপাদন করেছেন। “পতি ও পত্নী মৃত্যু পর্যন্ত একসাথে থাকবেন। তারা অন্য
কোন জীবনসঙ্গী গ্রহণ করবেন না বা ব্যাভিচার করবেন না। এই হলো নারী-পুরুষের
পরম ধর্ম।” (মনুসংহিতা ৯/১০১) “নারী ও পুরুষ একে ভিন্ন অপরে অসম্পূর্ণ।
এজন্য বেদে বলা হয়েছে ধর্মকর্ম পত্নীর সাথে মিলিতভাবে কর্তব্য”।
(মনুসংহিতা ৯/৯৬) এই শ্লোকটির কথা একবার ভেবে দেখুন। নারী ছাড়া পুরুষ
অসম্পূর্ণ একথা শুধুমাত্র হিন্দুধর্মই বলে থাকে। নারী ছাড়া পুরুষের
ধর্মকর্ম সম্পূর্ণ হয় না। বৈদিক যজ্ঞ ও ধর্মপালন স্বামী- স্ত্রী যুগ্মভাবে
করতে হয়, কেউ একাকী করতে পারেন না। একারণেই নারীকে বলা হয় পুরুষের
‘অর্ধাঙ্গিনী’ ও ‘সহধর্মিনী’। উল্লেখ্য, মনুসংহিতাই একমাত্র ধর্মশাস্ত্র
যেখানে এই বিখ্যাত কথা দুইটি অনুমোদন করা হয়েছে। সঙ্গত কারণেই হিন্দুধর্মে
বিবাহবিচ্ছেদ এবং বহুবিবাহ করতে নিষেধ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, অন্য ধর্মে
নারী পুরুষের অর্ধাঙ্গিনীও নয়, সহধর্মিনীও নয়। এই কথা মানতে নারাজ হলে একটি
মাত্র দৃষ্টান্ত দিচ্ছি- মসজিদে নারী-পুরুষ কি একসাথে নামাজ পড়া সম্ভব?
এমনকি নিজ গৃহেও স্বামী- স্ত্রী কি একসাথে নামাজ পড়তে পারেন? স্বয়ং বিবেচনা
করুন। এবার নারীদের স্বাতন্ত্রের কথায় আসা যাক। স্মর্তব্য, স্বাধীনতা মানে
উচ্ছৃঙ্খলা নয়, স্বাতন্ত্র্য মানেই ঔদ্ধত্য নয়। “যে স্ত্রী দুঃশীলতা হেতু
নিজে আত্মরক্ষায় যত্নবতী না হয়, তাকে পুরুষগণ ঘরে আটকে রাখলেও সে
‘অরক্ষিতা’ থাকে। কিন্তু যারা সর্বদা আপনা- আপনি আত্মরক্ষায় তত্পর, তাদের
কেউ রক্ষা না করলেও তারা ‘সুরক্ষিতা’ হয়ে থাকে। তাই স্ত্রীলোকদের আটকে
রাখা নিষ্ফল। স্ত্রীজাতির নিরাপত্তা প্রধানত তাদের নিজস্ব সামর্থ্য ও
মনোভাবের উপর নির্ভরশীল।” (মনুসংহিতা ৯/১২) এই শ্লোকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে,
নিরাপত্তার নামে নারীকে ঘরে আটকে রাখা নিষ্ফল। বিপরীতক্রমে তাকে নিরাপদ
রাখতে হলে তাকে অধিকার দিতে হবে এবং সঠিক শিক্ষা- দীক্ষা প্রদান করতে হবে।
নারীর সামর্থ্য ও প্রজ্ঞা বৃদ্ধি করতে হবে, মানবিক বিকাশ সাধনে তৎপর হতে
হবে, যার ফলশ্রুতিতে তারা যেন আত্মরক্ষায় তৎপর থাকেন, নিজেদের পরিপূর্ণ
মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। নারী জাতি সম্পর্কে এই হলো মহর্ষি মনুর
মতাদর্শ। “নারী অপহরণকারীদের মৃত্যুদণ্ড হবে।” (মনুসংহিতা ৮/৩২৩) “যারা
নারী, শিশু ও গুণবান পণ্ডিতদের হত্যা করে, তাদের কঠিনতম শাস্তি দিতে হবে।”
(মনুসংহিতা ৯/২৩২) “যারা নারীদের ধর্ষণ করে বা উত্যক্ত করে বা তাদের
ব্যাভিচারে প্ররোচিত করে তাদের এমন শাস্তি দিতে হবে যাতে তা অন্যদের মধ্যে
ভীতি সঞ্চার করে এবং কেউ তা করতে আর সাহস না পায়।” (মনুসংহিতা ৮/৩৫২)
ইভটিজিং এখন প্রধান একটা সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে, যার বিরুদ্ধে কঠোর কোন
শাস্তির ব্যবস্থা নেই। কিন্তু ইভটিজিং, অপহরণ ও ধর্ষণের দৃষ্টান্তমূলক
শাস্তির বিধান কিন্তু সেই মনুর যুগ থেকেই প্রচলিত ছিল। “যদি কেউ মা, স্ত্রী
বা কন্যার নামে মিথ্যা দোষারোপ করে তবে তাকে শাস্তি দিতে হবে।” (মনুসংহিতা
৮/২৭৫) অথচ নারীকে এই মিথ্যা দোষারোপ করেই প্রতিবছর হাজার হাজার নারীকে
‘অনার কিলিং’ করা হয়। অর্থাৎ হিন্দুধর্মের বিপরীত বিধানও অনেক সমাজে
প্রচলিত আছে। “যদি কেউ কোন ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া মা, বাবা, স্ত্রী বা
সন্তান ত্যাগ করে, তাকে কঠিন দণ্ড দিতে হবে।” (মনুসংহিতা ৮/৩৮৯) ভেবে
দেখুন, পথে- ঘাটে যত অনাথ শিশু দেখেন, যত নিশিকন্যা দেখেন, যত
পিতৃ-মাতৃতুল্য বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাকে হাত পেতে ভিক্ষা করতে দেখেন, তাদের মাঝে
কতজনকে আপনি হিন্দু দেখেছেন? হিন্দুদের মানবিক মূল্যবোধ অন্যদের চেয়ে
শ্রেষ্ঠ নয় কি? নিজেই বিচার করুন। “যদি কোন নারীকে সুরক্ষা দেবার জন্য
পুত্র বা কোন পুরুষ পরিবারে না থাকে, অথবা যদি সে বিধবা হয়ে থাকে, যে
অসুস্থ অথবা যার স্বামী বিদেশে গেছে, তাহলে রাজা তার নিরাপত্তা নিশ্চিত
করবেন। যদি তার সম্পত্তি তার কোন বন্ধু বা আত্মীয় হরণ করে, তাহলে রাজা
দোষীদের কঠোর শাস্তি দেবেন এবং সম্পত্তি ঐ নারীকে ফেরত দেবেন।” (মনুসংহিতা
৮/২৮-২৯) অর্থাৎ নারীর নিরাপত্তা বিধান ও অধিকার সংরক্ষণে দেশের সরকারকেও
সদা তৎপর থাকতে হবে। “নববিবাহিতা বধূ, কন্যা এবং গর্ভবতী মহিলাদের অতিথি
ভোজনের পূর্বেই ভোজন প্রদান করতে হবে।” (মনুসংহিতা ৩/১১৪) “বাহনে বা যানে
আরোহী ব্যক্তির পক্ষে বয়স্ক ব্যক্তি, ক্লান্ত ব্যক্তি, ভারবাহী ব্যক্তি,
বর, রাজা, স্নাতক এবং স্ত্রীলোকদের পথ ছেড়ে দেয়া কর্তব্য।” (মনুসংহিতা
২/১৩৮) এই মানবিক ভদ্রতা জ্ঞানটুকু আর কোন শাস্ত্রে আছে? Ladies First
তত্ত্বটা কিন্তু তাহলে বিদেশী নয়, বরং ভারতীয় রীতি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment