এটা ভীষণ দুর্ভাগ্যজনক যে, যে বিশ্বের হিন্দু সম্প্রদায়ে বেদ হলো সমাজের
মূল ভিত্তি, সেখানে আমরা ভুলেই গেছি বেদের মূল শিক্ষাগুলো এবং নিজেদেরকে
নানা ভুল-ভ্রান্তিসমূহের ধারণায় জড়িয়ে ফেলেছি যেমন, জন্মগত caste
system-সহ নানারকম বৈষম্য। এরকম বিপথগামী চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা আমাদের
সমাজকে ভীষণ ক্ষতিসাধন করেছে এবং বৈষম্যের সূত্রপাত ঘটিয়ে দিয়েছে। দলিত
নামক জাতিচ্যুত ব্যক্তিদের আমরা দূরে ঠেলে দিয়েছি এবং এর ফলে আমাদের
উন্নতি ও প্রগতির বিকাশ স্থবির হচ্ছে। এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে হিন্দু
সমাজের মূলে গিয়ে বেদকে জানা - যার ফলে আমরা আমাদের মধ্যে ভাঙা
সম্পর্কগুলো পুনরায় স্থাপণ করতে পারব। এই লেখায় আমরা চেষ্টা করব বেদ
অনুযায়ী আমাদের caste system সম্পর্কে প্রকৃত ইতিহাস উদঘাটন করার এবং
শূদ্রের আসল অর্থ খোঁজার। ১। প্রথমত, কোনো প্রকার হিংসা বা বৈষম্যের স্থাণ
নেই বেদে যেকোনো ব্যক্তি সম্পর্কে - সে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, বা
শূদ্র কিনা। ২। Caste system প্রায় নতুন। বেদে কোনো শব্দ নেই যার অর্থ
বর্ণ/জাতি হতে পারে। আসলে, caste, জাতি আর বর্ণ এগুলো এক একটি এক এক অর্থ
বহন করে। Caste হলো একটি ইউরোপীয় নবধারা যার সাথে বৈদিক সংস্কৃতির কোনো
সামঞ্জস্যতা নেই। জাতি 'জাতি'র অর্থ হচ্ছে এক শ্রেণীভুক্তকরণ যার উৎস হচ্ছে
জন্মে। ন্যায় সূত্র বলেছে "সমানপ্রসাভাত্মিকা জাতিহ্" অথবা তারা যাদের
একইপ্রকার জন্মসূত্র যা এদেরকে একটি জাতিতে সমষ্টিবদ্ধ করে। একটি প্রাথমিক
আরো বড় শ্রেণীভুক্তকরণ ঋষিদের দ্বারা করা হয়েছে চারভাবে: উদ্ভিজ (অর্থাৎ
গাছপালা), আন্ডাজ (অর্থাৎ ডিম থেকে যার উৎপত্তি যেমন পাখি এবং সরীসৃপ),
পিন্ডজ (স্তন্যপায়ী), উষ্মজ (তাপমাত্রা বা পরিবেষ্টনকারী আবহাওয়ার জন্য
যার জন্ম যেমন ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ইত্যাদি)। তেমনিভাবে নানাপ্রকার
পশুসমূহ যেমন হাতি, সিংহ, খরগোশ ইত্যাদি তৈরি করে এক ভিন্ন 'জাতি'। একইভাবে
সমস্ত মানবকুল তৈরি করে একটি 'জাতি'। একটি নির্দিষ্ট জাতির থাকবে একই
ধরনের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য যারা সেই জাতি থেকে আরেক জাতিতে পরিবর্তিত হতে
পারবে না এবং ভিন্ন জাতির বাচ্চা প্রসব করতে পারবে না। অর্থাৎ, জাতি হচ্ছে
ঈশ্বরের সৃষ্টি। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রেরা কোনোভাবেই ভিন্ন
জাতি নয় কারণ তাদের মধ্যে জন্ম সূত্রগত বা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগত কোনো
পার্থক্য নেই যা তাদেরকে ভিন্ন করবে। পরবর্তীতে 'জাতি' শব্দটি ব্যবহৃত হতে
শুরু করে যেকোনো প্রকার শ্রেণীভেদকরণের জন্য। তাই সাধারণ ব্যবহারের
ক্ষেত্রে আমরা ভিন্ন ভিন্ন সমাজকেও ভিন্ন ভিন্ন 'জাতি' হিসেবে আখ্যা দেই।
কিন্তু এ শুধু ব্যবহারের সুবিধার জন্য। আসলে আমরা মানবকুল এক জাতিরই অংশ।
বর্ণ প্রকৃত যে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য,
শূদ্র বোঝাতে তা হলো 'বর্ণ' ('জাতি' নয়)। 'বর্ণ' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এই
চারকে বোঝাতেই নয়, বরং দস্যু ও আর্যদেরকেও। 'বর্ণ' অর্থ হচ্ছে তাহাই যাহা
গ্রহণ করা হয় পছন্দের দ্বারা। তাই, যেখানে 'জাতি' ঈশ্বর দ্বারা প্রদত্ত,
'বর্ণ' হচ্ছে আমাদের নিজস্ব পছন্দগত। যারা আর্য হতে পছন্দ করে তাদের বলা
হয় 'আর্য বর্ণ'। তেমনি যারা দস্যু হতে পছন্দ করে, তারা হয় 'দস্যু বর্ণ'।
একইভাবে হয় ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। এই কারণেই বৈদিক ধর্মকে বলা হয়
'বর্ণাশ্রম ধর্ম'। বর্ণ শব্দটি ইঙ্গিত করে যে এটির ভিত্তি হচ্ছে নিজ
পছন্দকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া ও যোগ্যতা অনুসারে পরিচালিত ব্যবস্থাকে
অনুমোদন দেয়া। ৩। যারা বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত, তারা পছন্দ
করেন 'ব্রাহ্মণ বর্ণ'। যারা প্রতিরক্ষা, যুদ্ধ-বিগ্রহ পছন্দ করেন, তারা হন
'ক্ষত্রিয় বর্ণ'। যারা অর্থনীতি ও পশুপালনাদি পছন্দ করেন তারা হন 'বৈশ্য
বর্ণ' এবং যারা নিয়োজিত আছেন অন্যান্য সেবামূলক কাজ-কর্মে, তারা হন 'শূদ্র
বর্ণ'। এসব শুধু বোঝায় নানা ধরনের পছন্দ যেসব মানুষজন তাদের কর্মের জন্য
নির্বাচন করেন এবং এর সাথে 'জাতি' বা জন্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ৪। পুরুষ
সুক্তের অন্যান্য মন্ত্রসমূহ উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেছে যে, ব্রাহ্মণ
এসেছে ঈশ্বরের মুখ থেকে, ক্ষত্রিয় হাত থেকে, বৈশ্য উরু থেকে এবং শূদ্র পা
থেকে। সেইভাবে এইসব বর্ণসমূহ জন্মগত। কিন্তু কোনোকিছুই এর চেয়ে বেশী
ভ্রান্তিজনক হতে পারে না। আসুন দেখি কেন: (অ) বেদ ঈশ্বরকে বর্ণনা করে
আকারহীন ও অপরিবর্তনশীল হিসেবে। এমন ঈশ্বর কিভাবে বিশাল আকৃতির মানুষের রূপ
ধারণ করতে পারে যদি তিনি আকারহীনই হন? (যজুর্বেদ ৪০.৮) (আ) যদি ইহা সত্যিই
হয়, তাহলে তাহা বেদের কর্মতত্ত্বের বিরোধীতা করবে। কারণ কর্মতত্ত্ব
অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির জন্মগত পরিবার পরিবর্তিত হতে পারে তার কর্ম
অনুসারে। সুতরাং একজন ব্যক্তি যে শূদ্র পরিবারে জন্ম নেয়, পরের জন্মে এক
রাজার পরিবারে জন্ম নিতে পারে। কিন্তু যদি শূদ্রেরা ঈশ্বরের পা থেকে এসে
থাকে, তাহলে সেই একই শূদ্র ঈশ্বরের হাত থেকে কিভাবে জন্ম নেয়? (ই) আত্মা
হলো সময়হীন এবং কখনো জন্ম নেয় না। সুতরাং আত্মার কখনোই কোনো বর্ণ হতে
পারে না। এ শুধুমাত্র যখন আত্মা জন্ম নেয় মনুষ্য হিসেবে তখনই এর সুযোগ
থাকে বর্ণ বেছে নেবার। তাহলে বর্ণ দ্বারা কি বোঝানো হয় যা ঈশ্বরের একাংশ
হতে আসে? যদি আত্মা ঈশ্বরের দেহ থেকে জন্ম না নিয়ে থাকে, তাহলে কি এই
বোঝায় যে আত্মার দেহ তৈরি হয়েছে ঈশ্বরের দেহের অংশ থেকে? কিন্তু বেদ
অনুযায়ী, এমনকি প্রকৃতিও চিরন্তন। এবং এই একই অনু-পরমানু পুনর্ব্যবহৃত
হচ্ছে নানা মনুষ্যের মধ্যে। তাই কৌশলগতভাবে ঈশ্বরের দেহ থেকে জন্ম নেয়া
কারো পক্ষে অসম্ভব, এমনকি আমরা যদি ধরেও নেই ঈশ্বরের দেহ আছে। (ঈ) উপরে
উল্লেখ করা পুরুষ সুক্ত রয়েছে যজুর্বেদের ৩১তম অধ্যায়ে (এবং ঋগবেদ ও
অথর্ববেদ বাদে যেগুলোতে কিছু ভিন্নতা রয়েছে। যজুর্বেদে এ হচ্ছে ৩১.১১)।
প্রকৃতভাবে এর অর্থ কি তা বোঝার জন্য, আসুন দেখি এর আগের মন্ত্রের দিকে
লক্ষ্য করি ৩১.১০। এতে প্রশ্ন করা হয়েছে - কে মুখ? কে হাত? কে উরু আর কেই
বা পা? এর পরের মন্ত্র এর উত্তর দিয়েছে - ব্রাহ্মণ হলো মুখ, ক্ষত্রিয় হলো
হাত, বৈশ্য হলো উরু এবং শূদ্র হলো পা। লক্ষ্য করুন, মন্ত্রটি কিন্তু বলছে
না ব্রাহ্মণ "জন্ম নেয়" মুখ থেকে...এটি বলছে ব্রাহ্মণ "হলো" মুখ। কারণ যদি
মন্ত্রটির অর্থ হতো "জন্ম নেওয়া" তাহলে এটি উত্তর দিত না আগের মন্ত্রের
প্রশ্নটির "কে মুখ?" যেমন, যদি আমি প্রশ্ন করি "দশরথ কে?" উত্তরটি যদি হয়
"রাম জন্ম নেন দশরথের ঘরে" তাহলে তা হবে অর্থহীন। প্রকৃত অর্থ হচ্ছে: সমাজে
ব্রাহ্মণ বা বুদ্ধিজীবিরা তৈরি করে মস্তিষ্ক বা মাথা বা মুখ যা চিন্তা করে
এবং বলে। ক্ষত্রিয় বা রক্ষণকর্মীরা তৈরি করে হাত যা রক্ষা করে। বৈশ্য বা
উৎপাদনকারীরা এবং ব্যবসায়ীরা তৈরি করে উরু যা ভার বহন করে এবং যত্ন করে
(লক্ষ্য করুন উরুর হাড় অথবা উর্বাস্থি তৈরি করে রক্ত এবং এ হচ্ছে দেহের
সবচেয়ে শক্ত হাড়)। অথর্ববেদে উরুর বদলে "মধ্য" শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যার
অর্থ বোঝায় পাকস্থলী এবং দেহের মধ্যের অংশ। শূদ্র বা শ্রমিকেরা তৈরি করে
পা যা কাঠামোটিকে দাঁড় করায় এবং দেহকে চলতে সক্ষম করে। পরবর্তী
মন্ত্রগুলো আলোচনা করেছে অন্যান্য দেহের অংশ সম্পর্কে যেমন - মন, চোখ
ইত্যাদি। পুরুষ সুক্ত বর্ণনা করেছে সৃষ্টির সূত্রপাত এবং তার স্থায়ী থাকা
সম্পর্কে যার মধ্যে অন্তর্গত মানব সমাজ এবং বর্ণনা করেছে অর্থপূর্ণ সমাজের
উপাদানসমূহকে। তাই এ ভীষণ করুণ অবস্থা যে এমন সুন্দর সমাজ সম্পর্কে রূপক
বর্ণনা এবং সৃষ্টি সম্পর্কিত বর্ণনা বিকৃত হয়েছে যা সম্পূর্ণভাবে বৈদিক
মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। এমনকি ব্রহ্ম গ্রন্থগুলো, মনুস্মৃতি, মহাভারত,
রামায়ণ এবং ভগবদগীতা বলে নাই কোনোকিছুই যার কাছাকাছি উপপ্রমেয় হতে পারে
এমন অদ্ভূত যে ঈশ্বর তৈরি করেছেন ব্রাহ্মণদের তাঁর মুখ হতে মাংস ছিঁড়ে
কিংবা ক্ষত্রিয়দের তাঁর হাতের মাংস থেকে বা অন্যান্যসমূহ। ৫। তাই এটি
স্বাভাবিক কেন ব্রাহ্মণরা বেদ অনুসারে সবচেয়ে বেশী সম্মান লাভ করেছে।
এমনটিই হচ্ছে আজকের বর্তমান সমাজে। বুদ্ধিজীবিরা এবং অভিজ্ঞরা আমাদের
সম্মান অর্জন করেন কারণ তারা তৈরি করেন দিক প্রদর্শনকারী সারা মানবতার
জন্য। কিন্তু যেমনভাবে পূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, বেদে শ্রমের মর্যাদা
সমভাবে জোর দেওয়া হয়েছে এবং এই কারণেই কোনো প্রকার বৈষম্যের উপাদান নেই।
৬। বৈদিক সংস্কৃতিতে সবাইকে ধরা হয় শূদ্র হিসেবে জন্ম। তারপর ব্যক্তির
শিক্ষা-দীক্ষা দ্বারা সে পরিণত হয় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যতে। এই
শিক্ষা-দীক্ষার পূর্ণতাকে ধরা হয় দ্বিতীয় জন্ম। একারণেই এই তিন বর্ণকে
বলা হয় "দ্বিজ" বা দু'জন্মা। কিন্তু যারা রয়ে যায় অশিক্ষিত (যেকোনো
কারণেই হোক) তারা সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়। তারা চালিয়ে যায় শূদ্র হিসেবে
এবং করে যায় সমাজের সেবামূলক কাজসমূহ। ৭। এক ব্রাহ্মণের পুত্র, যদি সে তার
শিক্ষা-দীক্ষা সম্পূর্ণ করতে অসমর্থ হয়, পরিণত হয় শূদ্রে। তেমনিভাবে
শূদ্রের পুত্র অথবা এমনকি দস্যু, যদি সে তার শিক্ষা-দীক্ষা সম্পূর্ণ করে,
তাহলে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় কিংবা বৈশ্য হতে পারে। এ হচ্ছে নির্ভেজাল
যোগ্যতা অনুযায়ী ব্যবস্থা। যেমনভাবে এখনকার সময়ে ডিগ্রী প্রদান করা হয়,
যজ্ঞপবিত দেয়া হতো বৈদিক নিয়ম অনুসারে। তাছাড়া, আচরণবিধির সাথে অসম্মতি
ঘটলে যজ্ঞপবিত নিয়ে নেয়া হতো বর্ণগুলোর। ৮। বৈদিক ইতিহাসে অনেক উদাহরণ
রয়েছে বর্ণ পরিবর্তনের - (ক) ঋষি ঐতরেয়া ছিলেন দাস বা অপরাধীর পুত্র
কিন্তু তিনি পরিণত হন শীর্ষ ব্রাহ্মণদের মধ্যে একজন এবং লেখেন ঐতরেয়া
ব্রহ্ম এবং ঐতরেয়াপোনিষদ। ঐতরেয়া ব্রহ্মকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়
ঋগবেদ বোঝার জন্য। (খ) ঋষি ঐলুশ জন্মেছিলেন দাসীর ঘরে যিনি ছিলেন জুয়াখোর
এবং নিচু চরিত্রের লোক। কিন্তু এই ঋষি ঋগবেদের উপর গবেষণা করেন এবং কিছু
বিষয় আবিষ্কার করেন। তিনি শুধুমাত্র ঋষিদের দ্বারা আমন্ত্রিতই হতেন না
এমনকি আচার্য্য হিসেবেও অধিষ্ঠিত হন। (ঐতরেয়া ব্রহ্ম ২.১৯) (গ) সত্যকাম
জাবাল ছিলেন এক পতিতার পুত্র যিনি পরে একজন ব্রাহ্মণ হন। (ঘ) প্রীষধ ছিলেন
রাজা দক্ষের পুত্র যিনি পরে শূদ্র হন। পরবর্তীতে তিনি তপস্যা দ্বারা
মোক্ষলাভ করেন প্রায়ঃশ্চিত্তের পরে। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.১.১৪) যদি তপস্যা
শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ হতো যেমনভাবে উত্তর রামায়ণের নকল গল্প বলে, তাহলে
প্রীষধ কিভাবে তা করল? (ঙ) নবগ, রাজা নেদিস্থের পুত্র পরিণত হন বৈশ্যে। তার
অনেক পুত্র হয়ে যান ক্ষত্রিয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.১.১৩) (চ) ধৃষ্ট ছিলেন
নবগের (বৈশ্য) পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন এবং তার পুত্র হন ক্ষত্রিয়।
(বিষ্ণু পুরাণ ৪.২.২) (ছ) তার পরবর্তী প্রজন্মে কেউ কেউ আবার ব্রাহ্মণ হন।
(বিষ্ণু পুরাণ ৯.২.২৩) (জ) ভগবদ অনুসারে অগ্নিবেশ্য ব্রাহ্মণ হন যদিও তিনি
জন্ম নেন এক রাজার ঘরে। (ঝ) রাথোটর জন্ম নেন ক্ষত্রিয় পরিবারে এবং পরে
ব্রাহ্মণ হন বিষ্ণু পুরাণ ও ভগবদ অনুযায়ী। (ঞ) হরিৎ ব্রাহ্মণ হন
ক্ষত্রিয়ের ঘরে জন্ম নেয়া সত্ত্বেও। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.৩.৫) (ট) শৌনক
ব্রাহ্মণ হন যদিও ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্ম হয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.৮.১) এমনকি
বায়ু পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ ও হরিবংশ পুরাণ অনুযায়ী শৌনক ঋষির পুত্রেরা সকল
বর্ণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। একই ধরনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় গ্রীতসমদ,
বিতব্য ও বৃৎসমতির মধ্যে। (ঠ) মাতঙ্গ ছিলেন চন্ডালের পুত্র কিন্তু পরে
ব্রাহ্মণ হন। (ড) রাবণ জন্মেছিলেন ঋষি পুলৎস্যের ঘরে কিন্তু পরে রাক্ষস হন।
(ঢ) প্রবৃদ্ধ ছিলেন রাজা রঘুর পুত্র কিন্তু পরে রাক্ষস হন। (ণ) ত্রিশঙ্কু
ছিলেন একজন রাজা যিনি পরে চন্ডাল হন। (ত) বিশ্বামিত্রের পুত্রেরা শূদ্র হন।
বিশ্বামিত্র নিজে ছিলেন ক্ষত্রিয় যিনি পরে ব্রাহ্মণ হন। (থ) বিদুর ছিলেন
এক চাকরের পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন এবং হস্তিনাপুর রাজ্যের মন্ত্রী
হন। ৯। "শূদ্র" শব্দটি বেদে দেখা গেছে প্রায় ২০ বারের মতো। কোথাও এটি
অবমাননাকরভাবে ব্যবহৃত হয়নি। কোথাও বলা হয়নি শূদ্রেরা হলো অস্পর্শযোগ্য,
জন্মগতভাবে এই অবস্থাণে, বেদ শিক্ষা হতে অনুনোমোদিত, অন্যান্য বর্ণের
তুলনায় নিম্ন অবস্থাণের, যজ্ঞে অনুনোমোদিত। ১০। বেদে বলা হয়েছে শূদ্র
বলতে বোঝায় কঠিন পরিশ্রমী ব্যক্তি। (তপসে শূদ্রম্ - যজুর্বেদ ৩০.৫)
একারণেই পুরুষ সুক্ত এদের বলে পুরো মানব সমাজের কাঠামো। ১১। যেহেতু বেদ
অনুযায়ী চার বর্ণসমূহ বলতে বোঝায় চার প্রকারের কর্মকান্ড যা পছন্দের উপর
ভিত্তি করে, একই ব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে চার বর্ণের বৈশিষ্ট্য চার ভিন্ন
ভিন্ন পরিস্থিতিতে। এইভাবে সকলেই চার বর্ণের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সারল্যতার
জন্য, আমরা বলি প্রধান পেশাকে বর্ণের পরিচয় হিসেবে। এবং এই কারণে সকল
মানুষের উচিত পূর্ণভাবে চার বর্ণ হবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা, যেমনভাবে
বেদের জ্ঞান আমাদের বলে। এই হলো পুরুষ সুক্তের সারাংশ। ঋষি বশিষ্ঠ,
বিশ্বামিত্র, অঙ্গীরা, গৌতম, বামদেব ও কন্ব - এরা সকলেই চার বর্ণের
বৈশিষ্ট্যের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তারা বৈদিক মন্ত্রের অর্থ উদ্ভাবন
করেছেন, দস্যু দমন করেছেন, দৈহিক শ্রমের কর্ম করেছেন এবং নিজেদেরকে যুক্ত
করেছেন সমাজ কল্যাণের জন্য সম্পদ ব্যবস্থাপনায়। আমাদেরও উচিত এমনটিই
হওয়া। অবশেষে আমরা দেখলাম বৈদিক সমাজ সকল মানুষকে একই জাতি বা গোষ্ঠী
হিসেবে গণ্য করে, শ্রমের মর্যাদা বহাল রাখে, এবং সকল মানুষের জন্য সমান
সুযোগ প্রদান করে যাতে তারা নিজ নিজ বর্ণ গ্রহণ করতে পারে। বেদে কোনো
প্রকার জন্মগত বৈষম্যের উল্লেখ নেই। আমরা যেন সকলে একযুক্ত হয়ে একটি
পরিবারের ন্যায় একতাবদ্ধ হতে পারি, প্রত্যাখান করতে পারি জন্মগত সকল
বৈষম্যকে এবং একে অপরকে ভাই-বোন হিসেবে সদ্ব্যবহার করতে পারি। আমরা যেন সকল
পথভ্রষ্টকারীদের ভুল পথে এগুনো ব্যাহত করতে পারি যারা বেদে বর্ণভেদ
সম্পর্কে ভিত্তিহীন দাবী করে এবং দমন করি সকল দস্যু, অসুর, রাক্ষসদের। আমরা
যেন সকলে আসতে পারি বেদের আশ্রয়ে এবং একত্রে কাজ করে মানবতার বন্ধনকে আরো
দৃঢ় করতে পারি এক পরিবার হিসেবে। সুতরাং বেদ অনুযায়ী কোনো বর্ণভেদ নেই।
Post Top Ad
বেদে কোনো বর্ণভেদ নেই
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment